
লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে মিউয়ন-নিউট্রিনোর গতি সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিকদের হতবিহ্বল করেছে। তাদের পরীক্ষা বলছে সার্ন থেকে ৭৩২ কি.মি. দূরের গ্রান স্যাসো ল্যাবের উদ্দেশ্যে পাঠানো মিউয়ন-নিউট্রিনোটি প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে বিলিয়ন ভাগের একভাগ আগে পৌঁছে গেছে। আর প্রত্যাশিত সময়টা বের করা হয়েছে মহাবিশ্বের মধ্যে পর্যবেক্ষিত সর্বোচ্চ বেগ, যার সীমা দিয়ে গেছেন আইনষ্টাইন প্রায় ১০০ বছর আগে, তার পরিপ্রেক্ষিতে। এ পর্যন্ত করা অসংখ্য পরীক্ষাতে বারবার এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, আলোর বেগই আমাদের মহাবিশ্বের স্থানের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করার সর্বোচ্চ বেগ। সার্নের পর্যবেক্ষণের আরো ব্যাখ্যার আগে দেখা যাক আলোর এই বেগ যাকে মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য গতিবেগ বলা হয় তা বলতে আসলে কী বোঝায়, আর কী কী ক্ষেত্রে এই সর্বোচ্চ গতিবেগের সীমা লঙ্ঘিত হতে পারে।
আলোর বেগের সংজ্ঞাতে বলা হচ্ছে, কিছু কিছু প্রসেস আলোর চেয়ে বেশী বেগে সঞ্চারিত হতে পারে, কিন্তু তারা কোনো তথ্য বিতরণ করতে পারেনা। কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশনটা হচ্ছে স্রোডিংগারের সমীকরণের অধীন চলক(dependent function), যেটা স্থান-কালের কোনো নির্দিষ্ট অংশে ইলেকট্রনকে পাবার সম্ভাবনার পরিমাপ বলে দেয়। যখন ইলেকট্রনের অবস্থান বের করার জন্যে আমরা কণাটির উপর একটা মেজারমেন্ট নেই, কণাটি তৎক্ষণাত স্থান-কালের একটি নির্দিষ্ট অংশে তার অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে ফেলে, আর সারা মহাবিশ্ব জুড়ে ব্যপ্ত থাকা কোয়ান্টাম প্রবাবিলিটি ওয়েভ ফাংশনটি তৎক্ষণাত ভেঙ্গে পড়ে। এই ঘটনাকেই ওয়াভ ফাংশন কলাপ্স(Wave Function Collapse) বলে। আর এই ভেঙ্গে পড়া কিন্তু তাৎক্ষণিক, অর্থাৎ আলোর বেগের চাইতে অনেক অনেক বেশী বেগে তা ঘটে থাকে। কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টে দেখানো হয়েছে, এন্টেঙ্গেল্ড যুগল কণাদের একটির উপর কোনো গুণ/ধর্মের পরিমাপ নিলে যুগলের অন্য কণাটি কোনো বিলম্ব ছাড়াই তৎক্ষণাত অনুরূপ গুণ/ধর্ম ঠিক করে ফেলে ১০০% নিশ্চয়তার সাথেই। এক্ষেত্রেও আলোর বেগ কোনো বাঁধা নয়। কোয়ান্টাম নন-লোকাল কানেকশনে থাকা এন্টেঙ্গেল্ড যুগলের কণা দুটির মধ্যে আপাত তথ্য প্রদানের হারের নিম্নসীমা পরীক্ষাগারে বের হয়েছে আলোর বেগের চাইতে নিদেনপক্ষে ১০ হাজার গুন বেশী বলে।
ওয়েভ ফাংশন কোলাপ্স কিংবা কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্টের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাত ইন্টার্যাকশনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে আপাত দৃষ্টিতে আলোর বেগের চাইতে বেশী বেগে তথ্য বা প্রভাব বিনিময় হচ্ছে বলে মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু তা ঘটেনা। যেমন এন্টেঙ্গেল্ড যুগলের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে কণিকার গুণ পরিমাপ করার আগে কিন্তু অব্জার্ভার জানে না কোন্ কোয়ান্টাম স্টেটে কণাটিকে পাওয়া যাবে। এখন মেজারমেন্ট নেবার পরে কণাটির পরিমিত গুণটি জানা গেলে তা অন্য ল্যাবে থাকা দ্বিতীয় পর্যবেক্ষকের কাছে কিন্তু ক্লাসিক্যাল উপায়েই একমাত্র জানানো সম্ভব (যেমন ফোন কিংবা আলোক-বার্তার মাধ্যমে); আর সেটার উপর আলোর বেগের সীমা আরোপিত থাকছে। বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা থেকে যে প্রশ্ন জাগে তা হলো, তথ্য বিনিময় হোক আর নাই হোক, একটি কণার উপর মেজারমেন্ট নেবার সাথে সাথেই তো পর্যবেক্ষক জেনে যাচ্ছে যে অন্য ল্যাবে থাকা কণাটির অনুরূপ গুণ। আর সেটি তো ক্লাসিক্যাল উপায়ে তথ্য বিনিময়ের উপর নির্ভরও করছেনা।
উপরে বর্ণিত কোয়ান্টাম জগতের ঘটনা দুটি ছাড়াও ম্যাক্রো স্কেলে এমন আরো কিছু প্রসেস দেখা যায় যেক্ষেত্রে আপাত ভাবে আলোর বেগের চাইতে বেশী বেগ পরিলক্ষিত হয়।

রাতের আকাশের তারাগুলো এক-দিনে পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে আসে। সে হিসেবে সৌরজগতের সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা প্রক্সিমা সেঞ্চুরাই (৪ আলোকবর্ষ দূরে) এর আপাত গতি আলোর গতির কয়েকগুন। কিন্তু এখানে মূল ভুলটা হচ্ছে পৃথিবীকে স্থির ধরে হিসেবটা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ তত্ত্ব এডউইন হাবল ১৯২৯ সালে আবিষ্কার করেছিলেন। আর অতি সম্প্রতি দেখা গেছে যে মহাবিশ্ব আসলে ত্বরণসহ সম্প্রসারিত হচ্ছে। অদীপ্ত শক্তি বা ডার্ক এনার্জি নামক কল্পিত শক্তিকে মহাবিশ্বের পদার্থ-শক্তির সমীকরণে আনতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের এই ত্বরণসহ সম্প্রসারমান মাহাবিশ্বের ব্যাআখ্যার জন্য। হাবলের আবিষ্কার বলছে, যে গ্যালাক্সি যত দূরে তা তত বেশী হারে পরস্পরের কাছ থেকে অপসরিত হচ্ছে। এই হিসেবে এগুলে দেখা যায় যে পৃথিবী থেকে ১৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সির অপসারণ হার আলোর গতির চেয়েও বেশী। এর একটা স্বাভাবিক ইমপ্লিকেশন হচ্ছে, ১৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিরও বাইরের গ্যালাক্সির খোঁজ আমরা আমাদের আজকের বিজ্ঞানের সাহায্যে জানতে পারবোনা, কেননা, দূরের সেই সব গ্যালাক্সি থেকে বের হয়ে আসা আলোর চাইতেও বেশী বেগে খোদ গ্যালাক্সিই আমাদের থেকে অপসরিত হয়ে যাচ্ছে। ত্বরণসহ সম্প্রসারণশীল এই মহাবিশ্বে ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন মহাবিশ্বের সবগুলো গ্যালাক্সি পরষ্পরের থেকে আলোর বেগের চাইতেও বেশী বেগে অপসরিত হতে থাকবে। সেই সময়ে সব গ্যালাক্সিগুলোই একেকটা দ্বীপ মহাবিশ্বে পরিণত হবে।
যাইহোক, উপরে উল্লেখিত আমাদের এই মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলির পরষ্পরের সাপেক্ষে আলোর বেগের চাইতেও বেশী বেগে অপসরণের ঘটনা কি আইনষ্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে লঙ্ঘন করে? উত্তর হচ্ছে না। কেননা, আইনষ্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বে বলা হচ্ছে, স্থানের মধ্যে দিয়ে কোনো পদার্থ বা শক্তি আলোর বেগের চাইতে বেশী বেগে প্রবাহিত হতে পারেনা। কিন্তু স্থানের নিজের সম্প্রসারণ এই রীতির লঙ্ঘন করেনা। আজকের মহাবিশ্বে পর্যবেক্ষিত স্থানের এই সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের অব্যবহিত পরের ইনফ্লেশনের সময় থেকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইনফ্লেশন ফেজে মহাবিশ্ব একটা পয়সার আকার থেকে খুব অল্প সময়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চেয়েও কয়েক গুন বড় হয়ে গিয়েছিল। বিগ ব্যাং থিওরির মতো ইনফ্লেশন বা স্ফীতি তত্ত্বও আজকাল বৈজ্ঞানিক মহলে বেশ সমাদৃত, কেননা এটি মহাবিশ্বের সমতলতা (flatness problem) ও দিগন্ত (horizon problem) সমস্যার ব্যাখ্যা দিতে পারে ভালোভাবে। যাইহোক, মোদ্দা কথা স্ফীতিকালে মহাবিশ্ব অস্বাভাবিক হারে স্ফিত হয়ে যাওয়া ঘটেছিল আলোর বেগের চাইতে বিলিয়ন বিলিয়ন গুন বেশী হারে। কিন্তু আগের মতোই একইভাবে এটা স্থানের স্ফীতি; আর এই স্থানের স্ফীতির সাথে স্থানের মধ্য দিয়ে আরোপিত বেগের সীমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর তাই কসমিক ইনফ্লেশন আইনষ্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব লঙ্ঘন করেনা।
সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে লোকাল মেজারমেন্টের ক্ষেত্রে আলোর বেগের চাইতে কিছুটা বেশী বা কম বেগ পাওয়া কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হলেও (বিশেষত যেসব স্থান-কালে লোকাল বক্রতা আছে) সার্বিকভাবে আলোর বেগের সীমা লঙ্ঘিত হয়না। আর আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে, যেখানে ইনারশিয়াল ফ্রেম অফ রেফারেন্স পরষ্পরের সাপেক্ষে সমবেগে ভ্রাম্যমান ধরা হয় সেখানে আলোর বেগের সীমা লঙ্ঘনের কোনো বিধান একেবারেই নেই।
খুবই অল্প সময়ের জন্যে আলোর বেগের চেয়ে বেশী বেগে প্রভাব বিনিময়ের প্রমাণ আগে পাওয়া গেছে কাসিমির এফেক্টের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সময় ও অতিক্রান্ত দূরত্ব বেশ অল্প (যেমন মাইক্রোমিটার বা তারো কম দূরত্বের ক্ষেত্রে)। আর ভরবাহী কণার ক্ষেত্রে আলোর বেগের সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ মোটেই নেই বলা যায়, কেননা ভারী কণিকাকে আলোর বেগের কাছাকাছি নিতে হলে হয় অসীম পরিমাণ সময় লাগে কিংবা অসীম পরিমাণ শক্তি লাগে।
সার্নের পরীক্ষাগারে পাওয়া ফলাফল চমকপ্রদ অন্তত দু-ভাবে। প্রথমত, মিউয়ন নিউট্রিনো ভরবাহী কণা (যদিও অন্যান্য মৌলিক কণার চেয়ে এর ভর অনেক কম), ও পাড়ি দেয়া দূরত্ব অনেক বেশী (৭৩২ কি.মি.)। যাইহোক, সার্নের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা ও বিধৃতি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তারা তাদের পাওয়া ফলাফল পৃথিবীর অন্যান্য বিজ্ঞানীদের অ্যানালাইসিসের জন্যে পাঠাবেন; উদ্দেশ্য এই যে তারা কোথাও কোনো ভুল করছেন কিনা তা বের করা। তারা নিজেরা কিন্তু ১৫০০০ বারের চেয়েও বেশী বার পরীক্ষা করে একই রকমের ফলাফল পেয়েছেন।
তবে আসলেই যদি প্রমাণিত হয় যে ভরবাহী কণা আলোর বেগের চাইতেও বেশী বেগে অনেকখানি দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে, তাহলে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় আমূল পরিবর্তন আসবে। আর আমাদের প্রয়োজন পড়বে একশ বছরের অলঙ্ঘনীয় আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ব্যাপক পূনর্মূল্যায়ন ও পরিশীলন।
No comments:
Post a Comment